ডেঙ্গু ও তার হোমিওপ্যাথি প্রতিকার
ডাঃ প্রশান্ত কুমার ঝরিয়াত, হাওড়া নিউজ ২৪, উলুবেড়িয়া- উপক্রান্তিয় এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্ম-প্রধান দেশে ডেঙ্গু এবং ডেঙ্গু জ্বর একটি অত্যন্ত সাধারণ ভেক্টর-বাহিত ভাইরাসঘটিত রোগ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। ভারতবর্ষে প্রধানত প্রাক-গ্রীষ্ম এবং বর্ষা সময় এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি থাকে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যায়। এপ্রিল মাসে এই হাড় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। জুন-জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সাধারণত হ্রাস পেতে দেখা যায়। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশেও এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। সময় এবং অঞ্চল-বিশেষে এই রোগ মহামারির আকারও ধারণ করে। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, এবং দেরিতে চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের কোন বিশেষ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। সঠিক চিকিৎসায় বাড়ি তে থেকেই এই রোগের নিরাময় করা সম্ভব। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই রোগীকে হসপিটালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রেও 1–2 সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভাল হয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে। এই রোগ সম্বন্ধে জনমানসে সচেতনতা বৃদ্ধি ভীষণ জরুরী। সামান্য কিছু উপায় মেনে চললে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করেতে পারি। এই রোগ লোকালয়ে ছড়িয়ে পরার হাত থেকে সহজেই নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
এডিস ইজিপ্টাই মশার কামড়ে প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হন। এঁদের মধ্যে কারও কারও ক্ষেত্রে এই জ্বর মারাত্মক আকার নেয়। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলা হয় ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার। শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে এই ধরনের মারাত্মক অবস্থা বেশি দেখা গেলেও, ইদানীং কম বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও জ্বরের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। প্রাণ হারাচ্ছে অল্পবয়সিরাও। ১১ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গি জ্বর কেড়ে নিয়েছে ২৩ বছর বয়সি যাদবপুরের পড়ুয়া অহিদুর রহমানকে।যাঁদের এক বার ডেঙ্গি হয়ে গিয়েছে, তাঁদের দ্বিতীয় বার বা তৃতীয় বার ডেঙ্গি হলে তা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারে। ‘হেমারেজিক’-এর অর্থ রক্তপাত। রোগীর শরীরের বিভিন্ন ধমনী এবং শিরা ফেটে গিয়ে হুহু করে রক্ত এবং প্লাজমা বেরিয়ে যেতে শুরু করে। বাইরে থেকে রক্ত দিলেও অনবরত রক্তক্ষরণে রোগীর অবস্থা ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ – ডেঙ্গু জ্বর হল একটি মশা-বাহিত ভাইরাস-ঘটিত রোগ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবার ডেঙ্গু-তে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না। শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়। ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ গুলি হোল – উচ্চ জ্বর (40°C/104°F), তীব্র মাথার যন্ত্রণা , চোখের পিছনে ব্যথার অনুভূতি , মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধি (bone) তে যন্ত্রণা , বমিভাব, মাথাঘোরা, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া , ত্বকে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি। এই উপসর্গ গুলি রোগ সংক্রমণের 4 থেকে 10 দিনের মধ্যে দেখা দেয়। সাধারণত 2 থেকে 7 দিন পর্যন্ত উপসর্গ স্থায়ী হতে পারে। দ্বিতীয় বার ডেঙ্গু তে আক্রান্ত হলে রোগের ভয়াভয়তা বৃদ্ধি পায়। সেই কারনে পূর্বে ডেঙ্গু তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সতর্কতা মেনে চলতে বলা হয়।
ডেঙ্গুর গুরুতর উপসর্গ গুলি হোল – প্রচণ্ড পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি হওয়া, মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত, প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত, অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা ,ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (যা ক্ষতের মতো দেখাতে পারে),দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস, ক্লান্তি, বিরক্তি এবং অস্থিরতা। ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তনালীতে ছিদ্র তৈরি হয়। রক্ত রবাহে ক্লট-তৈরির কোষগুলির (প্ল্যাটলেট) সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এর জন্য মানুষের শরীরে শক লাগা, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, যে কোন অঙ্গের ক্ষতি এবং শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হতে পারে। রোগীর শরীরে গুরুতর উপসর্গ গুলির কোন একটি দেখা দিলে অতি অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত বা রোগী কে নিকটবর্তী হসপিটালে ভর্তি করানো দরকার। অন্যথায় রোগীর প্রাণসংকট হতে পারে।
ডেঙ্গুতে প্লেটলেটের সংখ্যা সাধারণত কত হয়? -স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সম্পন্ন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের প্লেটলেট সংখ্যা হয় 150,000 থেকে 450,000 প্লেটলেট প্রতি microliter রক্তে। উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীদের এই সংখ্যা 20,000 এর নিচে চলে যেতে পারে। এই সময় রক্তপাতের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হয়। মাঝারি ঝুঁকি পূর্ণ রোগীদের প্লেটলেট সংখ্যা 21-40,000/cumm মধ্যে থাকে। অবশ্য ডেঙ্গু সংক্রমণে অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটলেট সংখ্যার দ্রুত পরিবর্তন হয়। প্লেটলেট কাউন্ট কম এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তবেই প্লেটলেট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। অন্যথায় সংক্রমণ কমার সাথে সাথে আমাদের শরীরে স্বাভাবিক ভাবে প্লেটলেট কাউন্ট বৃদ্ধি পায়। এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ফোলেট এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহন। মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। পুরুষ মশা কেবল একদিন বাঁচে। নারী মশা সচরাচর ৬-৮ সপ্তাহ বেঁচে থাকে। আর পুরুষ মশা একদিনের বেশি বাঁচলেও; তাদের পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক হয়ে পড়ে। এডিস ইজিপ্টি মশা। ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রামিত এডিস প্রজাতির মশার (Ae. aegypti বা Ae) কামড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
সতর্কতা ও প্রতিরক্ষা:- ডেঙ্গু রোগ একটি জীবনঘাতক রোগ হতে পারে, তবে সতর্কতা এবং প্রতিরক্ষা প্রদান করে আমরা নিজেদের এবং অন্যকে ডেঙ্গু রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারি। মশা ডেঙ্গু রোগ বহন করে। সুতরাং, আপনার পরিবারের মশার প্রকোপ থেকে রক্ষা করুন। বাড়ির চারপাশে জল জমতে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। জমা জলে মশা বংশবিস্তার করতে পারে। জল জমে না থাকলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সপ্তাহে অন্তত একবার, এলাকাগুলি পরীক্ষা করুন। ফুলের পাত্র, গাড়ির টায়ার বা গাছের টবে জমে থাকা জল ফেলে দিন। ঢেকে রাখা পোশাক, যেমন লম্বা হাতা, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং জুতা পরুন। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর ও সন্ধ্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। রাতে ঘুমাতে গেলে মশারি ব্যবহার করুন। পারমেথ্রিন মতো রাসায়নিক ব্যবহার করুন যা মশা তাড়ায়।
ডেঙ্গু রোগীর খাবার- ভিটামিন সি (সাইট্রাস ফল, বেরি এবং শাকসবজিতে পাওয়া যায়), জিঙ্ক (সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি এবং বাদাম পাওয়া যায়), আয়রন (মাংস, মটরশুটিতে পাওয়া যায়), এবং ওটমিল (দ্রুত কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার শোষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ) হল সমস্ত পুষ্টি যা ডেঙ্গু রোগীদের প্রচুর প্রয়োজন। উচ্চ পটাশিয়াম, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ফোলেট এবং পেঁপে খাওয়া প্রয়োজন। উপরন্তু, শরীরকে হাইড্রেট করার জন্য প্রচুর পরিমাণে জল পান করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু রোগীদের হজম করা কঠিন এমন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। নন-ভেজিটেরিয়ান খাবার, চর্বিযুক্ত, তৈলাক্ত খাবার এবং সব ধরনের ভাজা খাবার।
উপসংহার – ডেঙ্গু জ্বর হওয়া সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু উপেক্ষা করলে এই অবস্থা মারাত্মক হতে পারে। শহুরে এলাকায় এটি বেশি দেখা যায়। তাই নগরবাসীকে আরও সজাগ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশি করে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।